বুধবার, ১৫ জুন, ২০১৬

আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যার দায়ে ৬ আসামির মৃত্যুদন্ড বহাল।!

আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যার দায়ে ৬ আসামির মৃত্যুদন্ড বহাল। খালাস পাওয়া আসামিদের বিষয়ে আপিল করবে পরিবার

ঢাকা, ১৫ জুন ২০১৬ এক যুগ আগে মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক, শ্রমিকনেতা গাজীপুর-২ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যার দায়ে ৬ আসামির মৃত্যুদন্ড বহাল রেখে রায় দিয়েছে আজ হাইকোর্ট।
মামলায় আসামিদের ডেথ রেফারেন্স, আপিলের উপর শুনানি শেষে এ রায় ঘোষণা করা হয়। গত বুধবার ৮ জুন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ উভয়পক্ষের শুনানি শেষে আজ রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেছিলো। আজ জনাকীর্ণ আদালতে চাঞ্চল্যকর এ মামলার রায় ঘোষণা করা হয়।
রায়ের শুরুতে কিছু অবজারভেশন দেয় বেঞ্চের সিনিয়র বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। এরপর রায়ের অপারেটিভ অংশ পড়ে শুনান অপর বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ। এর মধ্য দিয়ে এক যুগ আগে ঘটে যাওয়া নৃংশস এই হত্যাকান্ডের বিচার হাইকোর্টে শেষ হলো।
রায়ে আসামীদের মধ্যে ৬ জনের মৃত্যুদন্ড বহাল, ৮ জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও ১১ জন খালাস পেয়েছে। এছাড়া দুজন বিচার চলাকালে মারা যাওয়ায় তাদের আপিল নিস্পত্তি করে দেয়া হয়েছে। যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্ত অপর একজন পলাতক আসামির আপিল না থাকায় তার ব্যাপারে আদালত কোনো রায় দেয়নি।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যাকান্ড নি:সন্দেহে একটি জঘন্যতম ঘটনা। এ হত্যাকান্ডে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তয়ানে কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে তা উপলদ্ধি করা যায়। এ ঘটনাটি একটি ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ। আহসান উল্লাহ মাস্টার বেচেঁ থাকলে জনগণের কল্যাণে আরো অবদান রাখতে পারতেন। দন্ডিতরা তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে জাতিকে সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছেন। তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে একটি আদর্শকে হত্যা করা হয়েছে। তার মতো আদর্শবান নেতার এখন বড়ই অভাব ।
নিম্ন আদালতে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত ২২ আসামির মধ্যে হাইকোর্টে মৃত্যুদন্ড থাকা ছয় আসামি হলেন- নুরুল ইসলাম সরকার, নুরুল ইসলাম দিপু, মাহবুবুর রহমান মাহবুব, শহীদুল ইসলাম শিপু, হাফিজ ওরফে কানা হাফিজ এবং সোহাগ ওরফে সরু।
মৃত্যুদন্ড থেকে যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন, মোহাম্মদ আলী, আনোয়ার হোসেন আনু, জাহাঙ্গীর ওরফে ছোট জাহাঙ্গীর (পিতা আবুল কাশেম), রতন মিয়া ওরফে বড় রতন, আবু সালাম ওরফে সালাম ও সৈয়দ আহমেদ হোসেন মজনু, মশিউর রহমান মশু। যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্তদের প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরো এক বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয়।
মৃত্যুদন্ড থেকে খালাসপ্রাপ্তরা হলেন- আমির হোসেন, বড় জাহাঙ্গীর (পিতা নূর হোসেন), ফয়সাল, লোকমান হোসেন ওরফে বুলু, রনি মিয়া ওরফে রনি ফকির, খোকন ও দুলাল মিয়া। বিচারকি আদালতে দেয়া আসামি নুরুল আমিনের যাবজ্জীবন হাইকোর্টেও বহাল রয়েছে। এছাড়া বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন পাওয়া আসামি হাইকোর্টের রায়ে খালাসপ্রাপ্তরা হলেন- রাকিব উদ্দিন সরকার ওরফে পাপ্পু সরকার, আইয়ুব আলী, জাহাঙ্গীর (পিতা মেহের আলী) ও মনির।
বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত আসামি ওহিদুল ইসলাম টিপু (পলাতক) হাইকোর্টে আপিল করেননি। ফলে তার বিষয়ে কোন আদেশ দেয়নি আদালত। আইনজীবীরা জানান এ আসামির দন্ড বহাল রয়েছে।
সাজা ও খালাসপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে ১৭ জন কারাগারে, বাকি ৯ জন পলাতক রয়েছেন। অন্য কোনো মামলা না থাকলে খালাসপ্রাপ্ত যারা কারাগারে আছেন, তাদেরকে মুক্তি দিতে বলেছে আদালত।
গত ১৪ জানুয়ারি থেকে আসামিদের ডেথ রেফারেন্স, আপিল আবেদনের উপর হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয়ে গত বুধবার ৮জুন তা শেষ হয়। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, ডেপুটি এটর্নি জেনারেল রোনা নাহরীন ও সহকারী এটর্নি জেনারেল মনজু নাজনিন। রাষ্ট্রপক্ষকে সহায়তা করেন সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিষ্টার আমীর-উল ইসলাম, আবদুল বাসেত মজুমদার, ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, সৈয়দ সাজোয়ার হোসন। আসামিদের পক্ষে শুনানি করেন সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন, টি এইচ খান, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, এজে মোহাম্মদ অলী, এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকনসহ কয়েকজন আইনজীবী।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে আহসান উল্লাহ মাস্টারকে ২০০৪ সালের ৭ মে গাজীপুরের টঙ্গীর নোয়াগাঁও এম এ মজিদ মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এক জনসভা চলাকালে একদল সন্ত্রসী নির্মম ও বর্বরোচিতভাবে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনায় তার সঙ্গে আরো খুন হন ওমর ফারুক রতন নামে আরেকজন। এ ঘটনার পরদিন আহসান উল্লাহ মাস্টারের ভাই মতিউর রহমান বাদী হয়ে টঙ্গী থানায় ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও ১০/১২ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় তদন্ত শেষে ২০০৪ সালের ১০ জুলাই ৩০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। একই বছরের ২৮ অক্টোবর ৩০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করা হয়। বিচারিক আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ৩৪ জন এবং আসামিপক্ষে দুজন সাক্ষ্য দেয়।
মামলায় উভয়পক্ষে সাক্ষ্য ও যুক্তিতর্ক শেষে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন ২০০৫ সালের ১৬ এপ্রিল রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ৩০ আসামির মধ্যে গাজীপুর জেলার বিএনপি নেতা ও ওই সময় জাতীয়তাবাদী যুবদলের কেন্দ্রীয় শিল্প বিষয়ক সম্পাদক নুরুল ইসলাম সরকারসহ ২২ আসামিকে মৃত্যুদন্ড এবং ছয় আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়। এছাড়া খালাস পায় অন্য দুই আসামি।
নিম্ন আদালতের রায়ের পর ২২ আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদন্ড অনুমোদন) শুনানির জন্য ২০০৫ সালে হাইকোর্টে আসে। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ২২ আসামির মধ্যে ১৪ জন রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন করেন। মামলার তথ্য অনুসারে, আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যার পরিকল্পনার দায়ে বিচারিক আদালতের রায়ে বিএনপি নেতা নুরুল ইসলাম সরকারের মৃত্যুদন্ড হয়। মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত অন্য আরো ২১ আসামি হলেন- নুরুল ইসলাম দিপু, মোহাম্মদ আলী, মাহবুবুর রহমান মাহবুব, আমির হোসেন, সৈয়দ আহমেদ হোসেন মজনু, জাহাঙ্গীর ওরফে বড় জাহাঙ্গীর, শহীদুল ইসলাম শিপু, হাফিজ ওরফে কানা হাফিজ, আনোয়ার হোসেন ওরফে আনু, ফয়সাল, সোহাগ ওরফে সরু, লোকমান হোসেন ওরফে বুলু, আল আমিন, রতন মিয়া ওরফে বড় মিয়া, রনি মিয়া ওরফে রনি ফকির,জাহাঙ্গীর, রতন ওরফে ছোট রতন, আবু সালাম ওরফে সালাম, মশিউর রহমান ওরফে মনু, খোকন, দুলাল মিয়া।
যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত ছয় আসামি হলেন-রাকিব উদ্দিন সরকার ওরফে পাপ্পু সরকার, আইয়ুব আলী, জাহাঙ্গীর, নুরুল আমিন, মনির ও অহিদুল ইসলাম টিপু (পলাতক)। রায়ে খালাস পায় কবির হোসেন ও আবু হায়দার ওরফে মিরপুরইয়া বাবু।
মামলায় সংশ্লিষ্ট আইনজীবী সূত্র জানায়, মৃত্যুদন্ড পাওয়া ২২ আসামির মধ্যে আট আসামি পলাতক ও দুজন মৃত্যুবরণ করেছেন। পলাতক আটজন হলেন-নুরুল ইসলাম দিপু, সৈয়দ আহমেদ হোসেন মজনু, আনোয়ার হোসেন ওরফে আনু, ফয়সাল, রনি মিয়া ওরফে রনি ফকির, মরকুনের জাহাঙ্গীর, মশিউর রহমান ওরফে মশু ও খোকন। এছাড়া যাবজ্জীবন কারাদন্ড পাওয়া ছয় আসামির মধ্যে এক আসামি অহিদুল ইসলাম টিপুও পলাতক। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি ছোট রতন ও আল আমিন মৃত্যুবরণ করেন।
আজ হাইকোর্টে রায় ঘোষণা কালে আহসান উল্লাহ মাস্টারের ছেলে সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেলসহ আদালত অঙ্গণে গাজীপুর এলাকার কয়েক হাজার নেতা-কর্মী উপস্থিত ছিলেন।এদিকে খালাস পাওয়া আসামিদের বিষয়ে আপিল করবেন বলে জানান জাহিদ আহসান রাসেল।
স্থানীয়ভাবে শ্রমজীবী মানুষের কাছে জনপ্রিয় এ নেতা যুবক বয়সেই ১৯৮৩ ও ১৯৮৮ সালে দু’বার তার ইউনিয়ন পুবাইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। পরে ১৯৯০ সালে গাজীপুর সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হন তিনি। এরপর আহসান উল্লাহ মাস্টার ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে গাজীপুর২ আসন থেকে আওয়ামীলীগের মনোনয়নে প্রতিদ্বন্ধিতা করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদের সদস্য, জাতীয় শ্রমিক লীগের কার্যকরী সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন।

কোন মন্তব্য নেই:
Write comments