বৃহস্পতিবার, ১২ মে, ২০১৬

গাজীপুরের কালিয়াকৈরে জন্ম উপমহাদেশের অন্যতম শেষ্ঠ বিজ্ঞানী ড. মেঘনাদ সাহা


·        
·         
বর্তমান সংবাদ, তুহিন আহমেদ/আলমগীর হোসেন : উপমহাদেশের অন্যতম শেষ্ঠ বিজ্ঞানী ড. মেঘনাদ সাহা। ১৮৯৩সালের ৬ই অক্টোবর বর্তমান গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর উপজেলার  শেওড়াতলী গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে তিনি জন্মগ্রহন করেন। প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টির দিনে তার জন্ম হয় বলে প্রথমে তার নাম রাখা হয় মেঘনাথ পরে তা একটু বদল করে রাখা হয় মেঘনাদ। জগন্নাথ সাহা ও ভুবনেশ্বরী সাহার ৫ম সন্তান মেঘনাদ সাহা। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই মহান বিজ্ঞানীর নাম এখন অনেকেই ভুলে গেছে। কৃর্তিমান এই বিজ্ঞানীর জন্মদিন কিংবা মৃত্যু বার্ষিকী পালনে নেই কোন সরকারী-বেসরকারী ও সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগ।
মেঘনাদ সাহার শিক্ষা জীবন শুরু হয় তার গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। শিক্ষকরা তখনই আচ করতে পেরেছিলেন ছেলেটির মেধা অসাধারণ। গ্রামের পাঠশালায় লেখাপড়া শেষ হলে তার পিতা চেয়েছিলেন মেঘনাদ সাহাকে তার সাথে মুদি দোকানে বসাতে। কিন্তু মেঘনাদ সাহা লেখাপড়া করতে চাইলে তার পিতা আর বাধাঁ দেননি। বাড়ির আশেপাশে কোন স্কুল না থাকায় গ্রাম থেকে  সাত মাইল দূরে শিমুলিয়া এসপি হাই স্কুলে ভর্তি হন।  প্রথমে কিছুদিন এই সাত মাইল পথ পায়ে হেটে তাকে যাতায়াত করতে হত। পরে দাদা জয়নাথ সাহা শিমুলিয়া গ্রামের ডাক্তার অনন্ত কুমার দাসের বাড়িতে বাড়ির কাজকর্ম করে দেওয়ার বিনিময়ে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। 
১২ বছর বয়সে মেঘনাদ সাহা মাইনর পরীক্ষায় ঢাকা বিভাগে প্রথম হয়ে বৃত্তি লাভ করেন। ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন বাংলার গর্ভনর হন। লর্ড কার্জন বাংলাকে দুই ভাগে ভাগ করার ফন্দি আটেন। শুরু হয় বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন। এই আন্দোলনে মেঘনাদ সাহা জড়িয়ে পড়েন। ঢাকা কলিজিয়েট স্কুলে স্যার বামফিল্ড ফুলার স্কুল পরিদর্শনে এলে স্কু্েলর ছাত্ররা তার প্রতি অসম্মান দেখানোর জন্য খালি পায়ে স্কুলে আসে এবং বিক্ষোভ করে এই আন্দোলনে মেঘনাদ সাহা নেতৃত্ব দান  করেন।  ফলে তাকে সহ আরো অনেক ছাত্রকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়। মেঘনাদ সাহা পড়েন মহাবিপাকে।  ভাল ছাত্র হিসেবে তার নামডাক থাকায় ঢাকার বালিয়াটি গতিনি স্কুলে ভর্তি হন। 
১৯০৯ সালে এন্ট্রাস (প্রবেশিকা) পরীক্ষায় তৎকালীন পূর্ববাংলার ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে তিনি প্রথম স্থান লাভ করেন। ইংরেজী, বাংলা ও অংকে সর্বোচ্চ নাম্বার পান। এরপর তিনি ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। এখানেও তিনি কৃতিত্বের পরিচয় রাখেন। ১৯১১সালে আইএসসি (ইন্টারমিডিয়েট) পরীক্ষায় তৃতীয়স্থান লাভ করেন। ১৯১৩ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজ হতে বিএসসি গণিত বিভাগে প্রথম স্থান লাভ করেন। ১৯১৫সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত গণিত বিষয়ে এমএসসি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান লাভ করেন।
মেঘনাদ সাহার সহপাঠি ছিলেন প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক সত্যেন্দ্র নাথ বসু। তৎকালীন সরকার মেঘনাদ সাহাকে ১২৫টাকা মাসিক বৃত্তিতে প্রেসিডেন্সী  কলেজ থেকে জার্মান ভাষা শেখার জন্য নিয়োগ করেন। এদলে ছিলেন শৈলেন ঘোষ, সত্যেন বোষ এবং আরো কয়েকজন। এসময় জার্মান ও ইউরোপে পদার্থ বিদ্যার অনেক নতুন দিক আবিষ্কার হলেও তা ভারতবর্ষে প্রচার হয়নি। কারণ জার্মান ভাষা শেখা শিক্ষকের সংখ্যা ছিল খুবই কম। আলবার্ট আইনস্টাইন, নীলবোরস প্রমুখ বিজ্ঞানীদের নাম জানা থাকলেও তাদের আবিষ্কারের বিবরণ জানা ছিলনা। 
মেঘনাদ সাহার দায়িত্ব কোয়ান্টামবাদ নিয়ে পড়াশোনা। তিনি এক বছর ধরে জার্মান ভাষা শিখলেন। পরবর্তীতে মেঘনাদ সাহা কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। ড.মেঘনাদ সাহা ও সতেন্দ্র নাথ বসু আলবার্ট আইনস্টাইন কর্তৃক রচিত আপেক্ষিত তত্ত্ব ইংরেজীতে অনুবাদ করেন। পুস্তকটি পরবর্তীতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়।
১৯১৬ সালে স্যার আশুতোষ মুখার্জীর আহবানে মেঘনাদ সাহা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট গ্রাজুয়েট গণিত বিভাগে গবেষক হিসেবে যোগদান করেন এবং তার উপর বিভাগটির দায়িত্ব দেওয়া হয়। গবেষণায় তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দেন। এক বছরের মধ্যে তিনি আপেক্ষিক তত্ত্ব ও জ্যোতিবিজ্ঞানের ওপর মৌলিক গবেষণার জন্য ‘ডক্টর অব সায়েন্স’ উপাধি পান। 
১৯১৭ সালে ড. মেঘনাদ সাহা বিদুৎ চুম্বকের উপর গবেষণালব্ধ নিবন্ধ ‘ম্যাকওয়েল ষ্টাসেস’ ফিলোসফিকাল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়। তিনি ‘তেজস্ক্রিয় চাপ’এবং ‘নভো পদার্থ’ উপর অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ গবেষণা পরিচালনা করেন। ১৯১৮সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ‘বিদুৎ চুম্বক তত্ত্ব ও তেজস্ক্রিয়’ মৌলিক গবেষণার স্বীকৃতি স্বরূপ ডি.এস.সি খেতাব প্রদান করে। ১৯১৯সালে তার ‘বিকরন তাপ ও আপেক্ষিকতত্ত্ব’ শিরোনামে একটি মৌলিক নিবন্ধ এষ্ট্রোফিজিকাল জার্মানে প্রকাশিত হয়। একই বছর মেঘনাদ সাহা প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ বৃত্তি অর্জন করেন। 
১৯২০সালে তার থামার্য আয়োনিজেশন (পরমাণু সংক্রান্ত তত্ত্ব) প্রকাশিত হয়। এই তত্ত্ব আবিষ্কারের ফলে অনেক জটিল রহস্যের বিশ্লেষণ সহজ হয়ে যায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বৃত্তি দিয়ে তাকে উচ্চতর গবেষণার জন্য লন্ডন পাঠানো হয় এবং পরে তাকে সেখান থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয় ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে খন্ডকালীন অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯২৩ সালে ড.মেঘনাদ সাহা এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যায়ে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯২৬ সালে তিনি ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি ইতালি সরকারের আমন্ত্রনে ভোল্টা জন্মশত বার্ষিকী উদ্যাপনের অনুষ্ঠানে নিবন্ধ পাঠ করেন। তার একটি মৌলিক নিবন্ধ রেকর্ড অফ হাবার্ড কলেজে অবজারভেটারিতে প্রকাশিত হয়। 
১৯৩৪ সালে তিনি ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৩৫সালে মেঘনাদ সাহা ‘সায়েন্স এন্ড কালচার’নামে এক্িট মাসিক পত্রিকা বের করেন। ওই পত্রিকায় বিজ্ঞান, সমাজনীতি, অর্থনীতি, শিল্প পরিকল্পনা নিয়ে লেখা প্রকাশিত হত। ১৯৩৮সালে ড. মেঘনাদ সাহা এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অব্যাহতি নেন এবং  কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিভাগের অধ্যাপক নোবেল বিজয়ী সিডি রামনের স্থলাভিষিক্ত হন। 
১৯৪০সালে তিনি নিজ গ্রামে মায়ের নামে কালিয়াকৈরে প্রতিষ্ঠা করেন শেওড়াতলী ভুবেনশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়। যা পরবর্তীতে উচ্চ বিদ্যালয়ে উন্নীত হয়। ১৯৪৪সালে তিনি কলকাতা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স এর কাজ শুরু করেন। ১৯৪৮ সালে এর কাজ শেষ হয়। ১৯৫০ সালে মেঘনাদ সাহা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহন করেন। একই বছর তিনি উদ্বাস্তুদের সাহায্যের জন্য ইস্ট বেঙ্গল রিলিফ কমিটি গঠন করেন। প্রকৃৃতপক্ষে উদ্বাস্তুদের সাহায্য করতে গিয়ে তিনি প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ড.মেঘনাদ সাহা নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। ১৯৫২ সালে লোকসভায় সাধারণ নির্বাচনে তিনি কংগ্রেস বিরোধী প্রার্থী  হয়ে কলকাতার বড়বাজার আসন থেকে প্রতিদ্বন্ধিতা করে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। ১৯৫৫ সালে তিনি একই আসন থেকে নির্বাচন করে বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করেন। একই বছর ড.মেঘনাদ সাহা ‘ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন অফ কালটিভেশন অফ সায়েন্স’ পূর্নগঠন করেন। ১৯৭৯ সালের ১৬ফেব্রুয়ারী কলকাতা থেকে নয়াদিল্লী পার্লামেন্ট ভবনে যাওয়ার পথে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে তিনি মারা যান।
মেঘনাদ সাহার মৃত্যুর পর তার প্রতিষ্ঠিত কলকাতা ‘ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স’ এর নামকরন করা হয় ‘সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স’। তার বিখ্যাত ‘তাপ আয়ন তত্ত্ব’। তার অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশ চাঁদের বুকে একটি গহবরের নাম রাখা হয়েছে ‘মেঘনাদ সাহা গহবর’। সাহিত্য ক্ষেত্রে ড. সাহার কৃতিত্ব কম নয়। বৈজ্ঞানিক, সামাজিক, কৃষি ও জাতির উন্নয়ন সব বিষয়েই তার লেখা প্রকাশিত হয়েছে। সব মিলিয়ে তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১৮৬টি।
বর্তমান সংবাদ ২৪ ডটকম- সময় ও তারিখঃ Friday, 25 December 2015 19:50




কোন মন্তব্য নেই:
Write comments